টেকসই কৃষির প্রসারের লক্ষ্যে মানসম্পন্ন বীজ
উৎপাদনে বীজ প্রযুক্তি
ড. মো. আবু হেনা ছরোয়ার জাহান১ ড. পরিমল চন্দ্র সরকার২
কৃষির মৌলিক উপকরণ হলো বীজ যা খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি বিধানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে কয়টি উপকরণ ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে শুধুমাত্র বীজই হলো জীবিত। শুধুমাত্র মানসম্পন্ন বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন ১৫-২০% বৃদ্ধি করা যায়। অন্যদিকে বীজের মান খারাপ হলে ফসল উৎপাদন বহুলাংশে হ্রাস পায়। মানসম্পন্ন বীজ হতে উৎপন্ন সুস্থ সবল চারা উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণ যথা- সার ও পানির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে জমির একক প্রতি ফলন বৃদ্ধি পায়। ফলশ্রুতিতে দেশের মোট উৎপাদন বেড়ে যায় যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ফসল উৎপাদনের জন্য বীজ এবং খাবারের জন্য শস্যের মধ্যে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। বীজের ক্ষেত্রে অনেকগুলো বিষয় বিবেচনায় নিতে হয় যেমন-কৌলিতাত্ত্বিক শুদ্ধতা, জীবনীশক্তি, বীজমান যথা-বিশুদ্ধতা, গজানোর ক্ষমতা, আর্দ্রতা ইত্যাদি। বীজ উৎপাদনের জন্য শস্য উৎপাদনের চেয়ে অনেক বেশি সময়ের প্রয়োজন পড়ে তাই সার-সেচ-আগাছা ও আপদ বালাই ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ ভিন্নতর হয়ে থাকে। তাছাড়া বীজ উৎপাদনের জন্য মাটি ও আবহাওয়ার প্রতি বিশেষ নজর দিতে হয়। ভালো বীজ ব্যবহারে উৎপাদন খরচ কম পড়ে, ফসলে রোগবালাইয়ের উপদ্রব কম হয়, এর ফলে অধিক ফলনের পাশাপাশি বেশি লাভ হয়ে থাকে। প্রথমেই বীজ শ্রেণীর কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশে ফসলের বীজকে চার শ্রেণীতে ভাগ করা হয় যথা: প্রজনন বীজ, ভিত্তি বীজ, প্রত্যায়িত বীজ ও মানঘোষিত বীজ। বাণিজ্যিকভাবে বীজ উৎপাদন একটি বীজ প্রত্যয়ন পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বীজ প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্ত বিষয়সমূহ হবে ফসলের উন্নত জাত উদ্ভাবন, তাদের মূল্যায়ন ও অবমুক্তকরণ, বীজ উৎপাদন, বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ, বীজ গুদামজাতকরণ, সংরক্ষণ, বীজ পরীক্ষাকরণ, বীজ প্রত্যয়ন, বীজমান নিয়ন্ত্রণ, বীজ বিপণন ও বিতরণ এবং আধুনিক উদ্ভিদতাত্ত্বিক ও কৃষিতাত্ত্বিক বিজ্ঞানের আলোকে বীজের জৈবিক কার্যকলাপ, বীজ উৎপাদন এবং বীজ হ্যান্ডলিং নিয়ে গবেষণা করাই বীজ প্রযুক্তির কাজ। কাজেই বীজ ও খাদ্যশস্যের মধ্যে তফাৎ খুবই স্পষ্ট। বীজ প্রত্যয়ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে উৎপাদিত বীজ উন্নত মান বহন করে থাকে। উক্ত বীজ সুনির্দিষ্টভাবে কৌলিতাত্ত্বিক বিশুদ্ধ, আগাছা ও অন্যান্য বীজের মিশ্রণ থেকে মুক্ত, ভালো স্বাস্থ্য, উচ্চ গজানোর ক্ষমতাসম্পন্ন, নিরাপদ আর্দ্রতা সম্পন্ন ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে থাকে। কাজেই বীজ প্রযুক্তির বিভিন্ন ধাপ ও নীতিমালা অনুসরণ করে বীজের মান বজায় রাখা সম্ভব। কারণ বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণের যে কোনো স্তরে বীজের তেজ ও মানের অবনতি ঘটতে পারে। উন্নত বীজ উৎপাদন ও ব্যবহার ভালো ফলন পাবার পূর্বশর্ত :
উন্নত বীজ নতুন প্রযুক্তির বাহক। নতুন জাতের উন্নত বীজ উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণের যথাযথ সমন্বয়ে ফসলের ফলন অধিক বৃদ্ধি করে থাকে। উন্নত বীজ হলো খাদ্য সরবরাহের নিশ্চয়তা প্রদানকারী- বাংলাদেশের ফসলের বীজ উৎপাদন কর্মকা- এদেশে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির নিশ্চয়তা প্রদান করে থাকে। বাংলাদেশে ধান, পাট, সবজি ফসলের উৎপাদনে যে অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে, তা সম্ভব হয়েছে এদেশে উন্নত বীজ উৎপাদন কর্মকা-ের গতিশীলতার কারণে। উন্নত বীজ কম অনুকূল পরিবেশেও খাদ্য উৎপাদনের চালিকা শক্তি। কম অনুকূল পরিবেশেও মানসম্মত বীজ ভাল ফলন দিয়ে থাকে। উন্নত বীজ প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষির দ্রুত পুনর্বাসনের নিশ্চয়তা প্রদানকারী।
বীজ প্রযুক্তির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
বীজ প্রযুক্তির মূল উদ্দেশ্য হলো উচ্চফলনশীল জাতের মানসম্পন্ন বীজের দ্রুত প্রসারের মাধ্যমে দেশের কৃষির উৎপাদন বাড়ানো। বীজ প্রযুক্তির লক্ষ্য হলো-
প্রজননবিদ কর্তৃক উৎপাদিত জাতের বীজ দ্রুত সময়ে কৃষকের মাঝে সহজলভ্য করা; সঠিক সময়ে সরবরাহ করা- নতুন জাতের মানসম্পন্ন বীজ পর্যাপ্ত পরিমানে সঠিক সময়ে কৃষকের নিকট সরবরাহ করা; মানসম্পন্ন বীজের মূল্য কৃষকের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখা; বীজ উৎপাদনের মূল লক্ষ্য হলো কৌলিতাত্ত্বিক বিশুদ্ধ এবং ভালো মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন। বীজ উৎপাদনের সময় কৌলিতাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য বিবেচ্য বিষয়সমূহ হলো-
বীজের উৎস অবশ্যই সঠিক ও নির্ভরযোগ্য হতে হবে। (ভিত্তি বীজ উৎপাদনের জন্য প্রজনন বীজ এবং প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদনের জন্য ভিত্তি বীজ নির্বাচন করতে হবে।) বীজ অবশ্যই বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করতে হয়। মাঠে চাষকৃত পূর্ববর্তি ফসলের ইতিহাস জানা আবশ্যক যাতে ফসলের জাতের কৌলিতাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা বজায় থাকে। শস্যপর্যায় অবলম্বন করে ভালো মানের বীজ উৎপাদন করতে হয়। কৌলিতাত্ত্বিক শুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য একটি জাতের বীজ ফসলের সাথে অন্য জাতের যাতে পরাগায়ণ না ঘটতে পারে, সেজন্য স্বতন্ত্রীকরণ দূরত্ব বজায় রাখতে হয়। যে জায়গায় প্রয়োজনীয় স্বতন্ত্রীকরণ দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হয়না, সে ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বীজ বপন বা চারা রোপণ করে বীজ উৎপাদন করা যায়। ভালো বীজ উৎপাদনের জন্য বীজ ফসলের জমিতে অন্য জাত, অস্বাভাবিক গাছ ও রোগাক্রান্ত গাছ অপসারণ (রোগিং) করতে হয়। এ কাজটি গাছের বৃদ্ধির ২-৩টি ধাপে করতে হয়।
বাংলাদেশের অনেক কৃষকই আধুনিক বীজ প্রযুক্তি ব্যবহার না করে সনাতন পদ্ধতিতেই নিজের উৎপাদিত বীজের কিছু অংশ পরবর্তী বছরের জন্য সংরক্ষণ করেন। অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের গড় উৎপাদন কম হওয়ার অন্যতম কারণ বীজের সঠিক মাননিশ্চিত না করা। এজন্য জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত আদর্শ বীজমান বজায় রাখার জন্য বীজ উৎপাদনের কৃষিতাত্ত্বিক নীতিমালা অনুসরণ করে বীজ উৎপাদন করতে হয়। ‘টেকসই কৃষি’ বাস্তবায়নের জন্য বীজ প্রযুক্তির সঠিক ধারণা ও বাস্তবায়ন অপরিহার্য। এজন্যই ‘জাতীয় কৃষি নীতি-২০১৮’ এ বীজ প্রযুক্তি সম্পর্কে নিন্মোক্ত নীতি রাখা হয়।
বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের সহায়তায় আগ্রহী কৃষকদের সাথে মৌসুমভিত্তিক মতবিনিময় সভা/প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উন্নত বীজ উৎপাদন ও ব্যবহারে কৃষকদের অনুপ্রাণিত করা হবে। এবং মানসম্মত ও ভালোজাতের বীজ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে কৃষকের মাঝে বীজ বিনিময়কে উৎসাহিত করা হবে।
কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ ফসলের প্রজনন বীজ উৎপাদন করে থাকে, যা বিএডিসিসহ বেসরকারি বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করা হয়। এই বীজ থেকে পরবর্তীতে ভিত্তি ও প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করে কৃষককে প্রদান করা হয়ে থাকে। যার ফলশ্রুতিতে অধিক ফলন প্রাপ্তির মাধ্যমে দেশের পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা বিধানে এদেশের বিজ্ঞানীগণ ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশের বীজ খাত উন্নয়নের শক্তি
বীজ উৎপাদনের কর্মকা- চালনোর জন্য বীজ উৎপাদন উপযোগী বাংলাদেশের প্রায় সকল এলাকায় জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেম (ঘঅজঝ), বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন এবং কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তর এর অফিস স্থাপনা ও জনবল বিদ্যমান; জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেম কর্তৃক নতুন নতুন উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন; অধিকাংশ ফসলের বীজ উৎপাদন উপযোগী কৃষি পরিবেশ বিদ্যমান; শ্রমিক প্রাপ্যতা সহনীয় পর্যায়ে বিদ্যমান বীজ সেক্টরে সহায়ক; বীজ সেক্টরে সহায়ক সরকারি নীতি বিদ্যমান; সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহ প্রদান।
বাংলাদেশের বীজ খাত উন্নয়নের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ - মানসম্পন্ন বীজের চাহিদার তুলনায় সরবরাহের পরিমাণ কম থাকায় বীজ উৎপাদন বৃদ্ধি তথা বীজ খাত উন্নয়ন করলে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে এবং সাথে সাথে জাতীয় আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে; বছরব্যাপী ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে বীজের চাহিদা সারা বছরে বৃদ্ধি পাচ্ছে বিধায় এই খাত উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়ানোসহ বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
আমাদের দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য একটি লাগসই কৃষি ব্যবস্থা বজায় থাকা আবশ্যক। এজন্য চাহিদামাফিক মানসম্পন্ন বীজ কৃষকের নিকট সহজলভ্য হতে হবে। বীজ প্রযুক্তির সুষ্ঠু প্রয়োগ এ লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
লেখক : ১মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ২প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বীজ প্রযুক্তি বিভাগ, বিএআরআই, জয়দেবপুর, গাজীপুর। মোবাইল : ০১৭১৪৫৫২৫২১, ই-মেইল :cso.seed@bari.gov.bd